যাঁর নামের সঙ্গে মিশে আছে দেশপ্রেমের দীপ্তমান আভা। শ্রমজীবী মানুষের প্রেরণার বাতিঘর, বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক। মাত্র ২৯ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে শ্রমিক সমাজের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা। বলছি শহীদ অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের কথা।
আজ ২৮ ডিসেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের অকুতোভয় এই সৈনিকের ৪৭ তম শাহাদাত বার্ষিকী। তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পথচলা শ্রমজীবী মেহনতী মানুষের হৃদয়ে স্থান দখলকারী ৪২টি ট্রেড ইউনিয়নের কোনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবার কোনটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবু সুফিয়ানকে ৪৭ বছর পরেও আজকের এই দিনে খুলনা তথা সারা দেশের শ্রমজীবী মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
অধ্যাপক আবু সুফিয়ান চাঁপাইনবাগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার আড্ডা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। অতি ছোট্ট জীবনে আবু সুফিয়ান দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। তিনি শিক্ষা জীবনে বিএল কলেজ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৬৬-৬৭ সালে শাহ্ মাখদুম হলের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। পরবর্তীতে শ্রমিক অধ্যুষিত খুলনা অঞ্চলের শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায় শ্রমিক রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য সুফিয়ান বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধকালীন তিনি পলতা ইয়ুথ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন। যুদ্ধের সময় অসম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে যেসব বাঙালী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন তাদের কাছে পাকিস্তানী সেনা এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল্ শামসদের অত্যাচার, নির্যাতনের কথা শুনে কথিকা তৈরি করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সে কথিকা পাঠ করেন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ত্যাগী এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সরকার বীরপ্রতীক উপাধি প্রদান করে। এই মুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক জীবনে বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগের সহসভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের খুলনা জেলা শ্রম সম্পাদক এবং ৪২টি ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে খালিশপুর, দৌলতপুর, আটরা শিল্প এলাকায় ন্যায্য দাবি আদায়ে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তিনি কখনও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। এজন্য আজও খুলনা অঞ্চল তথা সারা বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ এই যোগ্য নেতার আদর্শকে অনুসরণ করে। তাঁকে স্মরণ করে এদিন খুলনাসহ সারা দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো আলোচনা, শোকর্যালি, দোয়া মাহফিল এবং কাঙালী ভোজের আয়োজন করে।
শিক্ষানুরাগী, ত্যাগী এই মুক্তিযোদ্ধা জীবনের স্বল্পতম সময়ে খালিশপুরে মহসিন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে ভাইস-প্রিন্সিপাল হিসেবে শিক্ষকতা করেন। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের পথিকৃৎ জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারকারী নেতাকে জাতির পিতা খুব স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে জার্মানিতে এক সম্মেলনে বাংলাদেশের শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে আবু সুফিয়ানকে পাঠিয়েছিলেন। দেশে ফেরার পর ১২ দিনের মাথায় আজকের এই দিনে খুলনা-যশোর রোডের মহসিন মোড় ইসলাম ম্যানশনে নিজস্ব অফিসে ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিটিং শেষে বাসায় ফেরার সময় রাত দশটার দিকে রাস্তার ওপর দুর্বৃত্তের গুলিতে মাত্র ২৯ বছর বয়সে শহীদ হন। একজন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের এদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার অসীম স্বপ্ন ছিল। সবার সব স্বপ্ন সব সময় তো আর পূরণ হয় না। বিপথগামী কিছু মানুষ সমাজে থাকে যারা সমাজের মানুষের মঙ্গল চায় না।
দেশপ্রেমিক আবু সুফিয়ানের সহধর্মিণী হিসেবে আজ ৪৭টি বছর আমি তাঁর দেখানো পথে তাঁরই স্বপ্নের জ্বলন্ত প্রদ্বীপ বহন করে চলেছি। স্বপ্নচারী কর্মঠ ত্যাগী মানুষটির অবদানকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তাঁর আদর্শ বুকে ধারণ করে নির্ঘুম রাত কাটাই বছরের পর বছর। মাত্র ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে ২১ বছর বয়সে আমি মহান এই মানুষটিকে হারিয়ে দু’চোখে অন্ধকার দেখি। জীবন তো আর থেমে থাকার নয়, অল্প বয়সে স্বামী হারানোর গভীর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে আমি শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়াই। এ দেশের লাখো কোটি শ্রমজীবী-মেহনতী-অসহায় মানুষের ভালবাসা এবং আমাদের সকলের আস্থার স্থল বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদ নিয়ে আজ আমি প্রতিনিধি হয়ে জনসেবার সুযোগ পেয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই আমার আজকের অবস্থান, শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি আর শ্রমিক নেত্রী মন্নুজান সুফিয়ান হয়ে ওঠার মূল প্রেরণা আবু সুফিয়ান। অধ্যাপক আবু সুফিয়ান তাঁর কাজের মাধ্যমে লাখো মানুষের অন্তরে অনাদিকাল বেঁচে থাকবেন। তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন স্বাধীনতার চেতনায় ভাস্বর কোটি মানুষের অন্তরে।
কবি ড. সুজিত কুমার বিশ্বাসের লেখা কয়েকটি চরণ উল্লেখ করে শেষ করতে করতে চাই-
এই জীবন তোমার কাছে
জানি কত মূল্যবান।
তুমি রাখো আপনার করে
তোমারই অবদান
শেষ কালে বলি- এক কথা,
ভালো থেকো চিরদিন।
তোমার স্বপ্ন লিখে আমি
বেঁচে আছি অমলিন।
শ্রমিক নেতা অধ্যাপক সুফিয়ান বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মের মাঝে, তাঁর আদর্শের মাঝে। আমার জীবনের সবচেয়ে বেদনাবিধুর দিনে গণমানুষের এই নেতার প্রতি আবারও জানাই অজস্র ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।
প্রকাশিত : দৈনিক জনকন্ঠ, পৃষ্ঠা নং ৭, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯